সরকার বলছে, "আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে।" কিন্তু প্রশ্ন হলো—কে এই কাজ করছে? সেনাবাহিনী? বিএনপি? সুশীল সমাজ? নাকি ভিন্নমত প্রকাশকারী নাগরিকরাই এখন ষড়যন্ত্রকারী? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, নির্বাচন চাওয়া বা সরকারের জবাবদিহিতা দাবি করা কি এখন ষড়যন্ত্রের সমতুল্য? আমরা যদি নির্মোহভাবে দেখি, তাহলে বলা যায় বিগত ৯ মাস সরকারের জন্য ছিল অত্যন্ত কঠিন সময়। সরকার এই সময়ে বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে—যেমন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে। ছোট-বড় অনেক আন্দোলনও মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে, একইসাথে, অস্বীকার করা যাবে না যে সরকার বহু ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা, একগুঁয়েমি ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো নিজেকে রাজনৈতিকভাবে প্রমাণ করতে গিয়ে নির্দিষ্ট একটি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করা।
সরকার তার বিবৃতিতে সেনাবাহিনীকে কার্যত প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছে—যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। আমরা দেখেছি, সরকারের মন্ত্রীরা সেনাবাহিনীকে "ভারতের দালাল" বা "পরাজিত শক্তির পৃষ্ঠপোষক" হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। এটি কোনোভাবেই দায়মুক্তি বা গণতান্ত্রিক আচরণ নয়—এটি রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে একধরনের "institutional breakdown" এর লক্ষণ। এ ধরনের মন্তব্য মিলে যায় Juan Linz-এর "authoritarian breakdown" থিসিসের সঙ্গে। তিনি দেখান, কীভাবে শাসকগোষ্ঠী তাদের বৈধতা হারাতে বসলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সন্দেহ ছড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি, এমন অবস্থায় সরকার নিজেকে একমাত্র রক্ষাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
সরকার আজ যেভাবে বলছে—"সব তথ্য প্রকাশ করে দেবে", সেটিও একধরনের রাজনৈতিক হুমকি। এটি একটি "shadow threat", যা দ্ব্যর্থতা তৈরি করে এবং রাজনৈতিক সমঝোতার পথ বন্ধ করে দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে: যদি তথ্য থাকে, এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? আর এই তথ্য কি কেবল তখনই প্রকাশ করা হবে যখন সরকার চাপে পড়বে? এই কৌশল হুবহু মিল খায় "Wag the Dog" রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে। এর অর্থ হল, সংকট ঢাকতে এক ধরনের কাল্পনিক বা নির্বাচিত সংকট সামনে আনা হয়, যাতে জনমত বিভ্রান্ত হয়।
সরকারকে বুঝতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতি মাল্টিলেয়ার এবং মাল্টি-অ্যাক্টর। সেনাবাহিনী, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি—এই সংকটের অংশ। সবারই কম-বেশি দোষ রয়েছে। তবে এরা সবাই সমাধানেরও অংশ। এদের কোনো একজনকে যদি গঠনমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে যেতে বাধ্য করা হয়, তবে তা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। এই সংকট মোকাবেলার জন্য দরকার একটি “inclusive transitional dialogue,”। কিন্তু সেই পথে না এগিয়ে সরকার বরং একতরফা ভাষায় সংকটকে দমনযোগ্য মনে করছে।
এই ধরনের অ্যাপ্রোচ রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। সরকার যদি নির্বাচনের তারিখ চাওয়ার গণতান্ত্রিক দাবিকে “জাতীয় স্বার্থবিরোধী” কিংবা “বিদেশি দালালি” বলে ব্যাখ্যা করে, তবে তা মূলত “delegitimization of dissent” এর textbook উদাহরণ হবে।
সরকারকে তার আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে। “আমরা সব প্রকাশ করে দেব”—এই ধরনের vague হুমকির বদলে সরকারকে তথ্য প্রকাশ করতে হবে এখনই। পাশাপাশি, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিকভাবে তাদের অবদান ও অবস্থানকে স্বীকৃতি না দিলে তারা ‘তৃতীয় পক্ষ’ হয়ে উঠতে পারে—যার ঝুঁকি ভয়াবহ। সেই ব্যাপারে সরকারকে যত্নশীল হতে হবে। পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি সহ সব দলকে নিয়ে একটি সর্বদলীয় সংলাপ দরকার, যেখানে নির্দিষ্ট সময়সূচিতে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হল—সরকারকে নিজেদের ব্যর্থতা অস্বীকার করে বিদেশি শক্তির দোষারোপ করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা একধরনের escapism। এটি কেবল বৈধ বিরোধীকেই অবৈধ করার কৌশলমাত্র।
No comments:
Post a Comment